Magic Lanthon

               

প্রবোধ মৈত্র; ভাব-ভাষান্তর : তাকিয়া সুলতানা ও জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত ২৪ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

চলচ্চিত্র ও রাষ্ট্র

প্রবোধ মৈত্র; ভাব-ভাষান্তর : তাকিয়া সুলতানা ও জাহাঙ্গীর আলম


ভারতে রাষ্ট্র ও চলচ্চিত্রের মধ্যে সম্পর্কের প্রকাশ পেয়েছে নির্বাচিত কিছু ক্ষেত্রে। ব্রিটিশ আমলে সেন্সরশিপ একটি বোধগম্য নীতিমালার অংশ ছিলো; শাসন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন বিষয় যতো দূরবর্তী হোক না কেনো, তার অনুমোদন দেওয়া হতো না। আরেকটি ক্ষেত্র ছিলো বিনোদনের ওপর শুল্ক আরোপ। শুরু থেকেই প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ বিষয়েও নিয়ন্ত্রণমূলক নীতিমালা বলবৎ ছিলো। ‘শিল্প’টি খতিয়ে দেখার জন্য গত শতাব্দীর ২০-এর দশকে সমগ্র ভারতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। অধিকাংশের মতামত নতুন শিল্পটির পক্ষে এবং ব্রিটিশ স্বার্থের অনুকূলে গেলেও প্রতিবেদনটি কেনো জানি দ্রুতই ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে।  

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতে স্বাধীনতার পরও উভয় ধরনের সেন্সরশিপই চালু থাকলো। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পরও ব্রিটিশ আমলের সেই চলচ্চিত্র মুক্তির আইনগত শর্ত এবং প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের নিয়ন্ত্রণকারী কৌশল বলবৎ ছিলো। বস্তুত সেন্সরশিপ ছিলো কেন্দ্রীভূত এবং তা কেন্দ্রীয় সরকারের সাংবিধানিক বিষয়। পরে রাজ্য সরকারের তালিকাতেও চলচ্চিত্রের বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়। মজার বিষয় হলো, স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক পরও চলচ্চিত্রকে ‘শিল্পখাতের মর্যাদা’ দেওয়া হয়নি। দৃশ্যত এ খাতের বাণিজ্যের প্রকৃতিকে দেখা হয় ফটকাবাজি হিসেবে। প্রোডাকশনের জন্য অর্থের যে উৎস, তা এর গুণগত মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, ফ্যাসিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে, সারাদেশে ফিল্ম থিয়েটারগুলোয় বাধ্যতামূলকভাবে সংবাদ পরিবেশন ও প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শন শুরু করে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে যুদ্ধকালীন সেই প্রোডাকশন শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে নিউজরিল ও প্রামাণ্যচিত্র তৈরির জন্য ফিল্ম ডিভিশন নামে তা আবার অচিরেই চালু হয়। যুদ্ধের সময় বাণিজ্যিক প্রেক্ষাগৃহগুলোয় প্রতি প্রদর্শনীর আগে ২০ মিনিট বরাদ্দ রাখার যে চর্চা ছিলো, ভারত সরকার ওই সব নিউজরিল ও প্রামাণ্যচিত্রের জন্য তা অব্যাহত রাখে। যখন কিছু রাজ্য সরকার নিজেদের প্রচার ও প্রচারণামূলক চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু করলো, তখন সময়টা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ভাগাভাগি করতে হলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছর এবং যখন ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো, সেসময় চলচ্চিত্রশিল্পের মৌলিক কাঠামো, বিশেষত স্টুডিওকেন্দ্রিক প্রোডাকশন ব্যবস্থা এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রেক্ষাগৃহ ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুরুর দিকে ফ্রিল্যান্সিং ব্যবস্থার অভিনেতা, অভিনেত্রী, কলাকুশলী ও সঙ্গীতজ্ঞদের ধন্যবাদ দিতেই হয়। এ সময় নতুন স্বাধীন প্রযোজক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যারা যুদ্ধের সময় আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়। নতুন প্রোডাকশন ও তার বাণিজ্যিক ব্যবস্থা ক্রমেই পেশাদার ও আন্তরিক চলচ্চিত্রকর্মীদের সরিয়ে দিলো এবং আগের সব সিস্টেমও অকার্যকর হয়ে পড়লো।

এ সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করে এবং বেশ বড়ো পরিসরে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন হয়। তাদের কিছু সুপারিশে, যেমন : চলচ্চিত্রে অর্থায়ন ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এগুলো বাস্তবায়নে ৫০ ও ৬০ দশক লেগে যায়। এরই মধ্যে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়া শুরু হয় ১৯৫৪-তে। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রযোজনা করে পথের পাঁচালী। তবে প্রযোজনার এ সিদ্ধান্তে নীতিগত বিষয়ের চেয়ে তরুণ, মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তির একটি প্রকল্প রক্ষার জন্য রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সহানুভূতি বেশি প্রকাশ পেয়েছিলো।

ভারত সরকার এ সময় দৃশ্যত বিভিন্ন ইন্সটিটিউট স্থাপনেও আগ্রহী হয়ে ওঠে। একে একে গড়ে ওঠে ফিল্ম ফাইন্যান্স করপোরেশন, ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার্স এক্সপোর্টস করপোরেশন (পরে এই দুই প্রতিষ্ঠান মিলে গঠিত হয় এন এফ ডি সি), ফিল্ম ইন্সটিটিউট (পরে যা ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট হয়), ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ ও চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটি। এছাড়া চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়ার জন্য একটি ফেস্টিভাল ডিরেক্টরিয়েট গঠন করা হয়। সরকারিভাবে একটি ফটো ফিল্ম করপোরেশনও গঠন হয় সেসময়। কর্ণাটক, কেরালা, অন্ধ্র প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও মহারাষ্ট্রের মতো কিছু রাজ্য সরকারও নিজ নিজ এলাকায় টেকসই চলচ্চিত্রের জন্য ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন গঠন করে।

এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। ফিল্ম ইন্সটিটিউট এবং ফিল্ম আর্কাইভের মতো সংস্থাগুলো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারতের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির কিন্তু খুব একটা ভূমিকা ছিলো না। এ দুটি সংস্থার একটি হয়েছিলো প্রশিক্ষণের জন্য, অন্যটি চলচ্চিত্র সংরক্ষণের জন্য। চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ ও সংরক্ষণ নিয়ে ইন্ডাস্ট্রির এই উদাসীনতা কিন্তু বিশ্বের অন্যতম এই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির নগ্ন বাণিজ্যিক দিকটিই ফুটিয়ে তোলে।

৫০ দশকের শুরু থেকে প্রেক্ষাগৃহের অপর্যাপ্ততার কারণে এ খাতের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। সেসময় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাস্তা, ভবন, হাসপাতাল, সেতু প্রভৃতি নির্মাণে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তবে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে এ ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়নি। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রেক্ষাগৃহ সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করে, যা পরবর্তী প্রজন্মের বিনোদন চাহিদা পূরণকে বাধাগ্রস্ত করে। এ পরিস্থিতিতে প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা বিশেষ সুবিধা নিতে থাকে। চলচ্চিত্র প্রদর্শন খাতে তাদের প্রভাব ছিলো, অনেক চলচ্চিত্রই তারা দেখাতে চাইতো না। এই পরিস্থিতিতে সেটা আরো প্রকট হয়। বেশিরভাগ রাজ্য সরকার চলচ্চিত্রকে শুধু বিনোদন করের উৎস হিসেবে বিবেচনা করতো। দেরিতে হলেও কিছু রাজ্যের উপলব্ধি হয় যে, সমস্যার সমাধানে ও চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। যদিও সাধারণভাবে পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছিলো এবং এ নিয়ে সরকারও ছিলো উদাসীন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার দিক হচ্ছে প্রোডাকশনের জন্য কাঁচামাল মজুদ, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি, ল্যাব, গবেষণা ও উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপনে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেই। ফলে গুরুত্বপূর্ণ খাতটির সুষম প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।

একটি নিষ্ক্রিয় ইন্ডাস্ট্রি¾আদৌ যদি সেটাকে ইন্ডাস্ট্রি বলা যায় এবং ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণনা করতে গেলে বাণিজ্যের বিষয়টি সবার আগে আসে। এর সঙ্গে রয়েছে উদাসীন রাষ্ট্রযন্ত্র সৃষ্ট নিম্নমানের চলচ্চিত্রিক পরিবেশ, পেশিশক্তির অপারেটরদের আনন্দপূর্ণ মৃগয়া ক্ষেত্র, পেশার ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতা, সততা ও বিশ্বস্ততার অভাব। অন্যদিকে এর জৌলুস ও চাকচিক্যকে দেখা হয় সর্বগ্রাসী প্রভাব হিসেবে। ফলে সরকারও কখনো কখনো চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে।

এ কথা অবশ্যই বলা যাবে না যে, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ভূমিকার প্রভাব নেই। প্রথমত, কেন্দ্রীয় সরকার কতকগুলো প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে যেগুলো পুরোপুরি কার্যকর না হলেও কিছু মূল্যবোধ মেনে চলে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সংযোগ ছাড়া হিন্দি এবং অন্য ভাষা বিশেষত বাংলা, কানাড়া, মালায়লামে নতুন ধারার (নিউওয়েভ) চলচ্চিত্র-নির্মাণ সম্ভব হতো না। তার পরও ফেস্টিভাল ডিরেক্টরিয়েট অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েই চলচ্চিত্র সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করে। অল্প সময়ে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রথাগত বিষয়ে পরিণত হয়। রাষ্ট্রীয় সংস্থার পছন্দের লোকজনদের নির্বাচকরা এ পুরস্কার দিচ্ছেন বলেও কথা উঠেছে।

যদিও ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী চলচ্চিত্র রাজ্য সরকারের বিষয়, তবে এ ইন্ডাস্ট্রি আন্তঃপ্রদেশ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে পরিচালিত হওয়ায় এতে সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করে কেন্দ্রীয় সরকার। স্বাধীনতার পর অনুসন্ধানকারী প্রথম কমিটি চলচ্চিত্রকে সমসাময়িক তালিকায় রাখার সুপারিশ করে। তবে তা কার্যকর হয়নি। কারণ রাজ্য সরকার বিনোদন কর থেকে বড়ো অঙ্কের রাজস্ব পেতো এবং এ বিষয়ে তারা ছিলো অনমনীয়। রাজ্যগুলো বরং আরো বেশি করারোপের পক্ষেই ছিলো।

আবার প্রদেশগুলো ভাষাগতভাবে ভিন্ন। তাদের মধ্যে এ উপলব্ধি স্বাভাবিক ছিলো যে, চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে শৈল্পিক প্রকাশ তখনই তাদের রক্ষাকবচ হবে, যখন শুধু রাজ্য সরকার চলচ্চিত্রের তত্ত্বাবধান, সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপ করতে পারবে। ফলে আইন ও নীতিমালা প্রয়োগ করে কোটা প্রথার মাধ্যমে প্রদেশের নিজস্ব ভাষায় বাধ্যতামূলকভাবে চলচ্চিত্র-নির্মাণের প্রচেষ্টা চলে। কল্যাণকর পদক্ষেপ, মজুরি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার স্থানীয় প্রযোজক, পরিবেশক, পরিদর্শক ও ট্রেড ইউনিয়নকে আস্থায় নেয়। আবার কিছু রাজ্যে চলচ্চিত্রের প্রোডাকশনকে দেখা হতে থাকে ঝামেলাপূর্ণ বিষয় হিসেবে।

যে বিষয়গুলোয় আন্তঃরাজ্য ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি যুক্ত থাকে, সেখানে কেন্দ্রের সহযোগিতা অনিবার্য। চলচ্চিত্রের আমদানি-রপ্তানি, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, আন্তর্জাতিক উৎসব প্রভৃতি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন এবং ৮০’র দশকের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রের বাধানিষেধ ও নিয়মকানুন থাকায় প্রত্যাশিত ফল আসেনি। জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা তৈরির বহু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এমনকি সুপারিশের জন্য কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু যখনই এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গৃহীত হয়েছে, তখনই তা বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে। এ ইন্ডাস্ট্রি সবসময়ই বিভক্ত থেকেছে। এরা মুনাফা ও অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যের প্রাথমিক তাড়না হিসেবে কাজ করেছে। ফলে সরকার যে সামান্য প্রস্তাব দিয়েছে, তারা সে সুবিধা নিতেও ব্যর্থ হয়েছে।

ফিল্ম ফাইন্যান্স করপোরেশনের (পরে এন এফ ডি সি) মতো সরকারি সংস্থা সবসময় তাদের হাতে থাকা ক্ষমতা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে, দেশের ছোটো ছোটো প্রেক্ষাগৃহগুলোর উন্নয়নে তারা বার বার কেবল আশ্বাস দিয়েছে। যদিও প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে সংস্থাটি প্রায়ই ভালোভাবে উতরে গেছে। প্রকৃতপক্ষে এটি নতুন চলচ্চিত্রের বার্তা নিয়ে এসেছে, দূরদর্শন বা অন্য যেকোনো মাধ্যমেই হোক না কেনো, ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রের পতাকা উড়িয়েছে। কিন্তু এতে বেসরকারি মালিকানাধীন প্রেক্ষাগৃহ নির্ভর ভালো চলচ্চিত্র প্রোডাকশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী খাতের এ দুর্বলতা এখনো রয়েই গেছে। ‘নন্দন’’ স্থাপনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ খাতে সহযোগী হওয়ার চেষ্টা করে। যেখানে শুধু বাংলা চলচ্চিত্র নয়, যেকোনো স্থানের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা হয়। বিভিন্ন জেলা পর্যায়েও রাজ্য সরকার এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।

এদিকে, শ্রাব্য-দৃশ্য ক্ষেত্রের অন্য আরেকটি সমস্যা পুরো চলচ্চিত্রবিশ্বকে বেকায়দায় ফেলেছে, বিশেষত আঞ্চলিক চলচ্চিত্রগুলোকে। দূরদর্শন, স্যাটেলাইট চ্যানেল ও ডিভিডি’র কারণে চলচ্চিত্রের দর্শক সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ফলে প্রেক্ষাগৃহ ও চলচ্চিত্র-নির্মাণের সংখ্যাও কমতে শুরু করে। যদিও চলচ্চিত্র-নির্মাণ ও পুরনো চলচ্চিত্রের রয়্যালটি দিয়ে এ ইন্ডাস্ট্রিকে সহায়তা করছে টেলিভিশন। কিন্তু চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির বিদ্যমান কাঠামোটি হুমকির মুখে রয়েছে।

এ ইন্ডাস্ট্রিকে সহায়তার জন্য পরিবর্তন, পুনঃসমন্বয়, উদ্ভাবন এবং প্রদেশ ও আন্তঃসরকার সহযোগিতা প্রয়োজন। চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি যখন ধুকে ধুকে মৃত্যুপথযাত্রী, তখন এর উত্তরণে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখতে পাওয়া ভার। পুঁজির উদারীকরণের বর্তমান ধারায় দেশের সরকার বিষয়টিকে কীভাবে মোকাবেলা করে সেটাই এখন দেখার বিষয়। সত্যজিৎ রায়ের নামে নতুন ফিল্ম ইন্সটিটিউট নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ; কিন্তু টেকসই প্রোডাকশনের জন্য বিদ্যমান ইন্ডাস্ট্রির পুনর্গঠন ও প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রোধ করার কাজটিই কষ্টসাধ্য।

অনেক রাজ্য সরকার শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে, অনুদানের মাধ্যমে চলচ্চিত্র-নির্মাণে সহায়তা ও পুরস্কার দিচ্ছে। ভিডিও ছবি ও চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক উৎসবের সূচনা করেছে কেরালা। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিনেমা কমপ্লেক্সসহ আর্কাইভ ও চলচ্চিত্র জাদুঘর স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া পুরস্কার প্রদান ও নিয়মিত উৎসবের আয়োজনও করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগ সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটাবে, কিন্তু মৌলিক সমস্যা¾চলচ্চিত্র-নির্মাণ হ্রাস, দর্শকের অনুপস্থিতি ও প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ প্রভৃতির সমাধানের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ভারতের দিকে নজর দিচ্ছে। হিন্দি ও তেলেগু ভাষায় বিদেশি চলচ্চিত্রের ডাবিং স্থানীয় চলচ্চিত্র-নির্মাণকে নাড়া দিয়েছে; উদারীকরণ হচ্ছে বৈশ্বিক প্রপঞ্চ। কারণ চলচ্চিত্র এমন একটি মাধ্যম যার কোনো সীমানা নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে বৃহৎ পরিসরে চলচ্চিত্র, টিভি ও ভিডিওকে বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান শ্রাব্য-দৃশ্য সম্পর্কিত ইস্যুগুলোর পর্যালোচনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট এবং প্রযুক্তির দ্রুত ও সতত পরিবর্তন বিবেচনায় রাখতে হবে। ভবিষ্যতে যে বিষয়টি সামনে আসবে তার আকার এখনো পরিষ্কার নয়, কিন্তু কোনো উদ্যোগ যেনো নীতিনির্ধারক, ইন্ডাস্ট্রি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কারণে ভেস্তে না যায়। আগামী দিনগুলোয় রাষ্ট্রের ভূমিকা সঙ্কুচিত হবে কি না তা পর্যবেক্ষণও একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়।

 

দায়স্বীকার : ‘Cinema and state’ শিরোনামে প্রবোধ মৈত্র’র এই প্রবন্ধটি 100 Years of Cinema গ্রন্থ থেকে নেওয়া। প্রবন্ধ সংকলনটি সম্পাদনাও করেছেন প্রবোধ মৈত্র। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে নন্দন, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, ১৯৯৫।

অনুবাদক : তাকিয়া সুলতানা, একটি মানবাধিকার সংস্থায় এবং জাহাঙ্গীর আলম, বণিক বার্তায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন।

rumitakia@gmail.com

alam_rumc05@yahoo.com

টীকা

১. ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার চলচ্চিত্রকে শিল্পের (Industry) মর্যাদা দেয়। সে বছর সেখানকার ৩০টি চলচ্চিত্র-নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ভারতের শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হয়।


বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন